লেবাননের জাতীয় কবি ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক- জিবরান খলিল জিবরান


লেবাননের জাতীয় কবি ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক-
জিবরান খলিল জিবরান
জাহিদুল ইসলাম পিরোজপুরী

একাধারে কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, ভাস্কর, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং অঙ্কনশিল্পী। বহিরাগত লেখক হিসেবে নিউইয়র্কের বেনেলিকার আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। ইংরেজী আরবী ভাষার লেখালেখি করেছেন। আরব বিশ্বে জিবরান বিদ্রোহী সাহিত্যিক রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। ক্লাসিক্যাল ধারা ডিঙ্গিয়ে তিনি আধুনিক আরবী সাহিত্যে রোমান্টিক স্টাইলে রেনেসাঁর প্রবর্তন করেন। এখনও লেবাননে তাঁকে সাহিত্যিক বীরপুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয়।
খলিল জিবরান পূর্ণ আরবি নাম জিবরান খলিল জিবরানকাহলিল জিবরান নামে পরিচিত আরবি: جبران خليل جبران‎‎ / ALA-LC: জুবরান খলিল জুবরান বা জিবরান খলিল জিবরান) ছিলেন একজন লেবানিজ কবি, লেখক ও শিল্পী।
কাহলিল জিবরান ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি বর্তমান লেবাননে অবস্থিত বিশাররি নামক পাহাড়ি পল্লীতে এক ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল খলিল জিবরান। জিবরানের মায়ের নাম ছিল কামিলা রাহমাহ। কামিলার বাবা ছিলেন একজন পাদ্রি। জিবরান তার মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। জিবরানের বাবা ছিলেন তার মায়ের তৃতীয় স্বামী।
আমেরিকা আসার দুই মাস পর ১৮৯৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ‘খলিল জিবরান’ গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। সে সময় ভুলবশত স্কুলের রেজিস্ট্রি বইয়ে তার নাম Khalil Gibran-এর বদলে Kahlil Gibran লেখা হলো। এভাবে তার বাবার দেয়া আসল নাম বিকৃত হয়ে গেল এবং জিবরানও পরে আর সে নাম শোধরানোর কোনো তাগিদ অনুভব করেননি।
জিবরানের বাবা প্রথম দিকে এক ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন। তার জীবন ছিল খুবই ছন্নছাড়া ও অগোছালো। তিনি জুয়া খেলায় আসক্ত ছিলেন, যে কারণে সব সময় থাকতেন ঋণগ্রস্ত। পরে তিনি এক অটোম্যান আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তার অধীনে কাজ নিয়েছিলেন। লেবানন তখন ছিল সিরিয়ার অঙ্গীভূত; আর সিরিয়া ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ। জিবরানের জন্মের সময় তার মায়ের বয়স ছিল ৩০। জিবরানের বয়স যখন মাত্র আট, তখন কর ফাঁকির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তার বাবাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ওই মামলায় তার সমস্ত সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ফলে কামিলা জিবরান, জিবরানের সৎভাই পিটার এবং দুই বোন মারিয়ানা ও সুলতানাকে নিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। কামিলা ঘুরেফিরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। তখন জিবরানের এক মামা থাকতেন আমেরিকায়। ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে ভাগ্য বদলের আশায় অনেক সাহস করে, কামিলা ১৮৯৫ সালের ২৫ জুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাজযোগে বৈরুত থেকে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার কিছু দিন আগে জিবরানের বাবা জেল থেকে ছাড়া পান বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তিনি পরিবারের সাথে আমেরিকা না এসে লেবাননেই থেকে যান।

জিবরানের মা আমেরিকাতে এসে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ঐতিহাসিক বোস্টন শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বসতি স্থাপন করেন। ওই সময় দক্ষিণ বোস্টনে জিবরানের মামাসহ আরবিভাষী অনেক সিরিয়ান ও লেবানিজ লোক থাকতেন। অন্য সিরিয়ান মহিলাদের সাথে জিবরানের মা এক পোশাক তৈরির কারখানায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেইস ও লিনেন দ্রব্যাদি বিক্রি করতে থাকেন।
মূলত অভাব-অনটনের কারণে ছোটবেলায় জিবরানের স্কুলে যাওয়া হয়নি। যেহেতু তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার কোনো রেকর্ড ছিল না, তাই অন্যান্য সব অভিবাসী ছেলেমেয়ের সাথে ইংরেজি শেখার জন্য তাকে একটি বিশেষ ক্লাসে ভর্তি করা হলো। একা একা তিনি পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গভীরভাবে অবলোকন উপভোগ করতেন! পরবর্তীকালে তার লেখায় এবং ছবি আঁকায়, পাহাড়, পর্বত প্রকৃতির প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। জিবরানের মা কামিলা ছিলেন রক্ষণশীল খ্রিষ্টান পরিবারের মেয়ে। তাই তাদের বাড়িতে ধর্মশিক্ষাদানের জন্য ঘন ঘন একজন পাদ্রির আনাগোনা ছিল। ওই পাদ্রির কাছে ভাসা ভাসাভাবে, জিবরান বাইবেলের সাথে ইতিহাস, বিজ্ঞান আরবি ভাষা শেখেন।
ছোটবেলা থেকেই জিবরান নিখুঁত ছবি আঁকতে পারতেন। তার এই বিরল প্রতিভা অচিরেই শিক্ষকদের নজর কাড়ে। স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় জিবরানের যোগাযোগ হয় তখনকার সময়ে বোস্টনের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ফ্রেড হল্যান্ড ডে-এর সাথে। ফ্রেড ডে জিবরানকে এতই পছন্দ করে ফেলেন, তিনি সাথে সাথে জিবরানের মেন্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি জিবরানকে বলতেন ন্যাচারাল জিনিয়াস ফ্রেড ডে-এর উৎসাহে এবং আনুকূল্যে জিবরান বইয়ের কাভার ডিজাইন, স্টোরি ইলাস্ট্রেশন এবং পোট্রেট আঁকার কাজ পেতে থাকলেন। এভাবে ছবি আঁকা চিত্রশিল্পের মহাজগতের সিংহদ্বার জিবরানের জন্য অতি সহজেই খুলে গেল! 

জিবরানের সৃষ্টিশীল বোস্টন-জীবনের শুরুতেই হঠাৎ একটা ছেদ পড়ে যায়। কী মনে করে বিশুদ্ধ আরবি শেখার জন্য তিনি ১৮৯৮ সালে ১৫ বছর বয়সে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ফিরে গিয়ে ভর্তি হন মাদরাসাতুল হিকমায় সেখানে আরো কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় আরবি ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। চার বছর পর বোস্টনে ফিরে আসেন ১৯০২ সালের ১০ মে। তার দুই সপ্তাহ আগে, তার বোন সুলতানা ১৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। পরের বছর তার ভাই পিটারও মারা যান একই রোগে। একই বছর জিবরানের মাও মারা যান ক্যান্সারে। (লক্ষ করার বিষয়, এখানে আরবি কবি জিবরানের জীবনের সাথে রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।) তারপর তার বোন মারিয়ানা সেলাইয়ের কাজ করে তাদের দুজনের সংসার চালাতেন। বৈরুত থেকে ফিরে এসে জিবরান, ফ্রেড ডে-এর সাথে পুরো উদ্যমে পেইন্টিংয়ের কাজ আবার শুরু করেন।
মেরি এলিজাবেথ হ্যাস্কেলের প্রেম ও জীবরানের সফলতায় তার অবদান- ১৯০৪ সালে তার প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় বোস্টনে, ফ্রেড ডে-এর স্টুডিওতে। এরপরই চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে জিবরানের নাম-ডাক। প্রদর্শনীতে জিবরানের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় হয় মেরি এলিজাবেথ হ্যাস্কেলের। মেরি হ্যাস্কেল ছিলেন স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মেরির সাথে অচিরেই গড়ে ওঠে জিবরানের বন্ধুত্ব। মেরির আগ্রহে এক সময় এই সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়, তবে প্রেম ছিল অনেকটা একতরফা। মেরি বিভিন্ন সময় জিবরানকে বিয়ে করতে চেয়েছেন। কিন্তু বারবার জিবরান তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে, ‘আমি বিবাহযোগ্য নই। তথাপি, মেরি হ্যাস্কেল নিজের টাকায় জিবরানকে দুই বছরের জন্য প্যারিস পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর চিত্রশিল্পী, অগস্ত রোদ্যাঁ-এর (১৮৪০-১৯১৭) সাথে থেকে আর্ট শেখার জন্য। জিবরানের শিল্পীজীবন তার সফলতার ওপর মেরি হ্যাস্কেলের অবদান প্রভাব খুবই বেশি। জিবরানের প্রতি মেরির প্রেম পরিণতি না পেলেও তাদের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব নিখুঁতভাবেই বহাল ছিল জিবরানের মৃত্যু পর্যন্ত।
জিবরানের প্রথম দিককার লেখা সবই আরবিতে। ইংরেজিতে তার প্রথম বই দি ম্যাড ম্যান বের হয় ১৯১৮ সালে। ১৯২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে সোসাইটি ফর অ্যারাব রাইটারস প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম বের হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ দি প্রফেট জিবরানের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্যান্ড অ্যান্ড ফোম, ‘জেসাস, দি সান অব ম্যান ইত্যাদি।
১৯১২ সাল থেকে জিবরান বোস্টন ছেড়ে নিউ ইয়র্ক শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন।
১৯৩১-এর ১০ এপ্রিল লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কেই তার জীবনাবসান ঘটে। জিবরানের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার লাশ লেবাননের বিশাররি-এর নিভৃত পল্লীতে নিয়ে সমাহিত করা হয়। জিবরানের কথা মতো, তার এপিটাফে লেখা আছে, 'A word I want to see written on my grave : I am alive like you, and I am standing beside you. Close your eyes and look around, you will see me in front of you.'

খলিল জিবরান এর হৃদয় , ভালবাসা নারী বিষয়ক বয়ান- 
·         অনেক নারীই পুরুষের হৃদয়কে ধার করে এবং সামান্য কিছু নারীই
তা অধিকারে রাখতে পারে  
·          যখন একজন পুরুষের হাত একজন নারীর হাত স্পর্শ করে তখন প্রকৃত
অর্থে তারা দুজনেই স্পর্শ করে অনন্তের হৃদয়  
·         প্রেমিক প্রেমিকার মাঝখানে ভালবাসা হল অবগুণ্ঠন  
·         প্রত্যেক পুরুষই দুজন নারীকে ভালবাসে একজন হল তার কল্পনার
সৃষ্টি এবং অন্যজনের এখনো জন্ম হয়নি  
·         পুরুষ নারীর ছোটখাটো ত্রুটিকেও ক্ষমা করে না , তেমনি উপভোগ করে না নারীর সদগুণ গুলো  
·          তুমি যদি তোমার অধিকারে থাক তাহলে অবশ্যই দাবী করার কিছু নেই  
·         ভালবাসা প্রতিদিন ভালবাসা নবায়ন করে না , যা পরিণত হয়েছে অভ্যাসে এবং এর
উল্টোদিকেই রয়েছে দাসত্ব  
·         ভালবাসা হচ্ছে আলোর একটি শব্দ , লেখা হয়েছে আলোর হাতে , আলো নির্মিত
কাগজের উপর  
·          যাকে তুমি ভালবাস , তুমি তার একজন দাস কারণ তুমি তাকে ভালবাস এবং একজন দাস ভালবাসে তোমাকে কারণ সে ভালবাসে তোমাকে  
·          তোমার মন বা আমার হৃদয় কখনোই একমত হবে না যতক্ষণ তোমার মন সংখ্যার ভেতরে এবং আমার হৃদয় ধোঁয়াশার ভিতরে বসবাস করা থেকে বিরত না হয়  
·          একজন নারী তার মুখের হাসি দিয়েই অবগুণ্ঠন তৈরি করতে পারে  
·          আমাদের মন হচ্ছে একটা স্পঞ্জ এবং হৃদয় হচ্ছে স্রোতধারা এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই আমাদের অধিকাংশই দৌড়ানোর চেয়ে শোসন করতে পছন্দ করে  
·          নিশ্চিত আনন্দের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বেদনার একটি অংশ এবং এটা বিস্ময়কর  
·          জীবন যখন তার হৃদয়ের কথা বলার জন্য একজন গায়ক খুঁজে পায় না তখন সে উপস্থিত করে একজন দার্শনিক কে তার মনের কথা বলতে  
সাহিত্যকর্ম সম্পাদনা - অল্প বয়সে তিনি তার পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন। এখানে তিনি শিল্পকলা নিয়ে পড়াশুনা করেন ও তার সাহিত্য জীবন শুরু করেন। তিনি ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই লিখতেন।জিবরানের প্রথম দিককার লেখা সবই আরবিতে। ইংরেজিতে তার প্রথম বই ‘দি ম্যাড ম্যান’ বের হয় ১৯১৮ সালে। ১৯২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে ‘সোসাইটি ফর অ্যারাব রাইটারস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম বের হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি প্রফেট’ জিবরানের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো…….
·         জেসাস
  • দ্যা প্রোফেট
  • ম্যাডম্যান
  • স্যান্ড এণ্ড ফোম
  • ব্রোকেন উইংস
  • গার্ডেন অব প্রফেট
  • দ্যা ওয়াণ্ডারা
·         দি সান অব ম্যান’ ইত্যাদি। 
১৯১২ সাল থেকে জিবরান বোস্টন ছেড়ে নিউ ইয়র্ক শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন।ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত তার ১৯২৩ সালের বই দ্য প্রফেটের কারণে পরিচিত। তার বইটি ১৯৩০ এর দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৬০ এর দশকেও তা জনপ্রিয় ছিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার  লাউযির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের কবি।
আরব বিশ্বে জিবরানকে সাহিত্য রাজনৈতিক বিদ্রোহী হিসেবে দেখা হয়। আধুনিক আরবি সাহিত্যের রেনেসায় তার রোমান্টিক ধারা ধ্রুপদি ধারা থেকে আলাদা ভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষত তার গদ্য কবিতা। লেবাননে তিনি এখনো সাহিত্যের বীর হিসেবে সম্মানিত হন।


৪টি মন্তব্য:

প্রকৃত মুসলমান হওয়ার জন্য প্রত্যেক মুমিনের আল্লাহওয়ালা সমাজকেন্দ্রিক হওয়া উচিত। _ হযরত কায়েদ ছাহেব হুজুর রহ.